শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ০৪:৫৪ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
করোনাজর্জর একটি বছর

করোনাজর্জর একটি বছর

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী:

আরেকটা বছর আমাদের জীবন থেকে বিদায় নিচ্ছে। তবে অন্যান্য বছর যেভাবে গেছে, এ বছরটি সেভাবে কাটেনি। ‘কান্না হাসির দোলা দোলানো পৌষ ফাগুনের খেলা’র মধ্য দিয়ে এ বছরটা যায়নি। এ বছরটা কেটেছে অবিরাম মৃত্যু আর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। যে বছরটি আসছে, সে-ও বিদায়ি বছরটির উত্তরাধিকার বহন করবে কি না জানি না। যদি বহন করে, তাহলে তো মৃত্যু আর মৃত্যুর ভয়াবহ গ্রাস থেকে মানবতার মুক্তি নেই। এই গণমৃত্যুর প্রতিষেধক ভ্যাকসিন অবশ্য বেরিয়েছে। কিন্তু তার কার্যকারিতা কতটুকু আর পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষকে কত দ্রুত এই টিকা দেওয়া যাবে, তা এখনো জানা যায়নি।

আমার বয়স এখন প্রায় ৯০ ছুঁই ছুঁই। এই দীর্ঘ জীবনে অনেক ভয়াবহ বিপর্যয় দেখেছি। সেই সব বিপর্যয়ের কোনোটিই ২০২০ সালের বিপর্যয়ের সমতুল্য নয়। আমার জন্মের কয়েক বছর পরেই বাংলা ১৩৪৮ সালের সেই ভয়াবহ সাইক্লোন। সেই সাইক্লোনে গোটা উপকূলীয় জেলাগুলো ধ্বংস হয়েছিল। এই ধ্বংসের জের না কাটতেই ১৩৫০ বঙ্গাব্দের সেই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। সে দুর্ভিক্ষে ৫০ লাখ লোকের অনাহারে মৃত্যু হয়েছিল। এই দুর্ভিক্ষ ও মন্বন্তরের পাশাপাশি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ধাক্কাও এসে লেগেছে তখনকার অবিভক্ত বাংলাদেশে। যুদ্ধের সময় হাজার হাজার বাঙালি যুবক সেনাবাহিনীতে চাকরি নিয়ে রণাঙ্গনে চলে গেছে। তারপর যুদ্ধ শেষে বেকার হয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে। গ্রামে-শহরে-বন্দরে চুরি, ডাকাতি, ধর্ষণ ব্যাপকভাবে দেখা দেয়।

তারপর চোখের সামনে দেখলাম পাকিস্তান হওয়ার প্রাক্কালে ১৯৪৬ সালে কলকাতা, বিহার ও নোয়াখালীর দাঙ্গা। এই দাঙ্গায় কত লাখ মানুষ নিহত হয়েছে, কত লাখ নারী নির্যাতিত হয়েছে তার হিসাব নেই। পাশের হিন্দু বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে, প্রতিবেশী মুসলমানরা পানিভর্তি কলস হাতে নিজ বাড়িতে যাতে আগুন এসে না পৌঁছায় তার চেষ্টা চালাচ্ছে। এমন দৃশ্য দেখার অভিজ্ঞতাও মনে রয়েছে।

চোখের সামনে দেশ ভাগ হয়েছে। হাজার হাজার হিন্দু-বৌদ্ধ পরিবার বহু জন্মের ভিটামাটি ফেলে কাঁদতে কাঁদতে ভারতে পাড়ি দিয়েছে। সেই দৃশ্য যেমন দেখেছি, তেমনি দেখেছি অচেনা-অজানা বিহারিরা সেসব পরিত্যক্ত বাড়ির দখল নিচ্ছে। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি ও সেপ্টেম্বরে জিন্নাহ ও গান্ধীর মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ উপমহাদেশকে দেখলাম, দেখলাম ভাষা আন্দোলন, মুজিব নেতৃত্বের উত্থান এবং ছয় দফার আন্দোলন। ১৯৭১ সালের সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামকেই ভেবেছিলাম জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতা। এর চেয়ে কোনো বড় অভিজ্ঞতা মানুষের জীবনে আর কী থাকতে পারে?

আগের সব অভিজ্ঞতার জন্যই মনে একটা প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু ২০২০ সালের অভিজ্ঞতার জন্য মনে কোনো প্রস্তুতি ছিল না। মনে হয়েছিল, এই খ্রিস্টীয় সালটিও কোনো দেশে বন্যা, কোনো দেশে মহামারি, কোনো দেশে রাষ্ট্র বিপ্লব এবং কোনো দেশে খাদ্যাভাব ইত্যাদি ঘটনার আনন্দ-বিষাদের মধ্যে চিরাচরিতভাবে কেটে যাবে। কিন্তু ২০২০ সেভাবে কাটেনি। গত প্রায় ১০০ বছরেও ২০২০ সালের কোনো তুলনা নেই। ধ্বংসের এত বড় তাণ্ডব বিশ্বব্যাপী আর কখনো ঘটেছে কি না জানি না।

নুহের বন্যা লোকশ্রুতি। ইতিহাসে তার কোনো সঠিক বিবরণ নেই। স্পেনের প্লেগ, ব্রিটেনের ব্ল্যাক ফিভার, ভারতের দাঙ্গা, অবিভক্ত বাংলার দুর্ভিক্ষ, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি ঘটেছিল পৃথিবীর অঞ্চলবিশেষে। সারা পৃথিবীয় একযোগে নয়। কিন্তু ২০২০ সালের কভিড-১৯-এর হামলা বিশ্বব্যাপী। সুপারপাওয়ার আমেরিকায় এই ভাইরাস যেভাবে হামলা চালিয়েছে, তেমনি হামলা চালিয়েছে ছোট্ট জর্দান নামের দেশটিতে।

এত বড় সুপারপাওয়ার আমেরিকা, অর্থনৈতিক সুপারপাওয়ার চীন, এশিয়ার সাব সুপারপাওয়ার ভারত—এত মারণাস্ত্র নিয়েও কভিড-১৯-এর মোকাবেলা করতে পারছে না। এই মহামারি নিজ থেকে যাবে তার কোনো আশা নেই। ছোট-বড় প্রতিটি দেশেই রোজ শত শত লোক মারা গেছে এবং যাচ্ছে। লকডাউন, সোশ্যাল ডিস্ট্যান্স কোনো কিছুই এই ভাইরাসকে তেমন ঠেকাতে পারছে না। ভ্যাকসিন যেমন বেরিয়েছে, তেমনি বেড়েছে এই ভাইরাসের উইন্টার অ্যাগ্রেসন।

২০২০ সাল যে বাংলাদেশের বরেণ্য এত ব্যক্তিকে নিয়ে যাবে তা কোনো দিন ভাবতেও পারিনি। ড. আনিসুজ্জামান, ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী, ড. বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, কামাল লোহানী, আলী যাকের, খ ম জাহাঙ্গীর প্রমুখ আমাদের সাংস্কৃতিকজগতের বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ কেউ আজ নেই। বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যুবরণ করেছেন এমন ডাক্তার, নার্স, সাংবাদিকের সংখ্যা কম নয়। এর ফলে দেশটির যে ক্ষতি হয়েছে তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়।

২০২০ সালের একটি শুভ খবর, মার্কিন প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচনে ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক মাফিয়াচক্রের গুরু ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরাজয়। কিন্তু ব্যক্তি ট্রাম্প বিশ্বরাজনীতি থেকে সরে গেলেও ট্রাম্পইজম বা ট্রাম্পের বর্ণবিদ্বেষী ও ফ্যাসিবাদী রাজনীতি আমেরিকা থেকে সহজে সরে যাবে না। কভিড-১৯-এর মতো থেকে যাবে। কভিডকে যেমন ভবিষ্যতে ভ্যাকসিন দিয়ে ক্যান্সার ও টিবির মতো নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে, ট্রাম্পইজমকে উত্খাত করা না হলে নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না।

কুড়ি সালের আরেকটি অভিশাপ ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার নতুন উত্থান। মধ্যপ্রাচ্যে জিহাদিস্ট ও ইসলামিস্ট সন্ত্রাসীদের উৎপাত একটু কমলেও ইউরোপের ফ্রান্সে তাদের উৎপাত বেড়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতে ধর্মীয় মৌলবাদীরা যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করেছে। ভারতে দলিত সমাজসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর এই কুড়ি সালে নির্মম অত্যাচার বেড়েছে। বাংলাদেশে মৌলবাদী ও সন্ত্রাসীরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম বীর নায়ক বাঘা যতীনের স্ট্যাচুতে পর্যন্ত আঘাত হেনেছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, পরাজিত জামায়াতিরা হেফাজতের ভেতরে দলে দলে ঢুকেছে। আল্লামা শফীর মৃত্যুর পর মওলানা বাবুনগরীর নেতৃত্বে এই জামায়াতিরা হেফাজতের সাইনবোর্ডের আড়ালে সংগঠিত হচ্ছে এবং সরকার তাদের দাবি না মানলে সরকারের বিরুদ্ধে শোডাউনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।

কুড়ি সালে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারের আরো দুটি বড় অর্জন, ভারতের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতার আরো কয়েকটি চুক্তি এবং পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ প্রায় সম্পন্ন। আরো একটি সুখবর, বঙ্গোপসাগরে নদীবিধৌত পলি জমা পড়ে বাংলাদেশের সংলগ্ন হয়ে বিরাট দ্বীপ জেগে ওঠা। এই বিশাল ভূমিতে ভবিষ্যতে বাড়তি জনসংখ্যার বাসস্থান নির্মাণ এবং বিভিন্ন জাতের ফসলের উৎপাদন সম্ভব হবে। বিশেষজ্ঞরা এ কথা বলছেন।

কুড়ি সালের একটি বড় আন্তর্জাতিক দুঃসংবাদ, মধ্যপ্রাচ্যে ট্রাম্পের চাপে পড়ে  সৌদি আরব, আমিরাতসহ আরব দেশগুলোর ইসরায়েলকে স্বীকৃতিদান এবং ফিলিস্তিনের মুক্তিসংগ্রামীদের একা ও সহায়হীন হয়ে যাওয়া। একমাত্র ইরান ও সিরিয়া ছাড়া ফিলিস্তিনিদের সমর্থক আর কেউ রইল না। ইরানকেও ট্রাম্প ক্রমাগত অর্থনৈতিক অবরোধ বাড়িয়ে কাহিল করে এনেছিলেন। এখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের পরাজয় এবং জো বাইডেনের জয়লাভের ফলে অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক বলছেন, ইরানের ওপর মার্কিন অর্থনৈতিক অবরোধ হয়তো কিছুটা কমবে এবং মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান অচলাবস্থা দূর হওয়ার পথে এগোবে।

তেহরানের আল কাইহান কাগজে এক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক লিখেছেন, আরব দেশগুলোর বাদশাহ ও শেখরা ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করায় তা ফিলিস্তিনিদের জন্য শাপে বর হবে। অপরের ওপর নির্ভরতা ত্যাগ করে ফিলিস্তিনের গেরিলা দলগুলো এখন নিজেদের মধ্যে বিভেদ ঘোচাবে এবং ঐক্যবদ্ধ হবে। যেসব দেশের শাসকরা ইসরায়েলের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, সেসব দেশের সাধারণ মানুষ তাদের শাসকদের বিরুদ্ধে আরো বেশি ক্ষুব্ধ হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে এই আরব দেশগুলোতে আরেকটি ‘আরব বসন্ত’ দেখা দিতে পারে। যদি তা দেখা দেয়, তাহলে এবারের আরব বসন্তে অনেক বাদশাহ ও শেখের পতন ঘটতে পারে। ইসরায়েলকেও চরম বেকায়দায় পড়তে হতে পারে।

বাংলাদেশ সরকার কুড়ি সালের সব অভিশাপ প্রায় কাটিয়ে উঠেছে। কভিড-১৯ মোকাবেলার ক্ষেত্রে তারা বহির্বিশ্বেও সুনাম অর্জন করেছে। হেফাজতি উত্থান ঠেকিয়ে রাখার কাজে আওয়ামী লীগ সরকারের পন্থা সমালোচিত হলেও সাফল্য সরকারের বিরোধীরাও স্বীকার করছে। এখন করোনার ভ্যাকসিন সংগ্রহ এবং দেশের মানুষকে ব্যাপকভাবে টিকাদানের ক্ষেত্রে দলীয় মন্ত্রী, এমপি এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের দুর্নীতি ঠেকিয়ে রাখতে পারলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা আগামী সাধারণ নির্বাচনেও তাঁর দলের জয়লাভ সুনিশ্চিত করে তুলবে।

কুড়ি সালের অনেক অভিশাপের মধ্যে কয়েকটি আশীর্বাদের একটি হলো, মার্কিন রাজনীতিতে ক্রমাগত ওলট-পালট, ট্রাম্পের সহসা উত্থান ও পতন বাংলাদেশের একট সুধীসমাজকে দিশাহারা করে ফেলেছে। এবার ভাস্কর্য বিতর্কের মধ্যেও তাদের কণ্ঠ শোনা যায়নি। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সুধীরা স্ট্র্যাটেজি ঠিক করতে পারছেন না। কোন দিকে যাবেন, ভাস্কর্যের পক্ষে, না বিপক্ষে? এ ব্যাপারে আটলান্টিকের ওপার থেকে কোনো দিকনির্দেশনা এখনো আসেনি।

লন্ডন, সোমবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২০

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877